কলেরা নিয়ে কারসাজি!

ঢাকা: দেশে কি কলেরা আছে? এমন প্রশ্নের কোনো সহজ উত্তর দিতে পারেন না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কেউ। কলেরায় আক্রান্ত বা মৃত্যুর কোনো তথ্য নেই অধিদপ্তরের ড্যাশবোর্ড বা কন্ট্রোল রুমেও। কলেরার নাম পর্যন্ত নেই। অধিদপ্তরের উন্মুক্ত নথিপত্রেও সহজে কলেরার তথ্য-উপাত্ত বের করা যায় না, যেমনটি পাওয়া যায় অন্য সব রোগের ক্ষেত্রে। তবে আড়ালে-আবডালে ঠিকই কলেরা নিয়ে কাজ চলে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ঠিকই দেশে কলেরার ভয়ানক পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরা হয় সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজনে।

এমন এক তথ্যেই দেখা মিলেছে দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার মানুষ কলেরায় আক্রান্ত এবং ৩ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার প্রকাশ্যে কলেরার কথা স্বীকার করতে চায় না, কিন্তু ঠিকই গোপনে কলেরা নিয়ে কাজ করছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরছে দেশে কলেরার প্রাদুর্ভাব নিয়ে।

এ বিষয়ে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক এমপি বলেন, ‘কলেরা নিয়ে এখন আর রাখঢাক করার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। কলেরা যে দেশে নেই, সেটি বলা যাবে না। তবু বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যারা কাজ করেন, তারা ভালো বলতে পারবেন। দেশে কলেরা থাকার ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোনো নিষেধাজ্ঞাও আছে বলে মনে হয় না।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য সচিব (সেবা) মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “একসময় কলেরা ছিল, এখন তো সবই ডায়রিয়া। ‘কলেরা’ বলতে কোনো বৈজ্ঞানিক সমস্যা আছে কি না, সেটা আমার জানতে হবে। তবে সাধারণভাবে বলতে পারি কলেরা-ডায়রিয়া একই ধরনের পানিবাহিত রোগ। ডায়রিয়া তো দেশে আছেই, সেটি তো অস্বীকার করা হচ্ছে না বরং সারা দেশেই ডায়রিয়ার ভালো চিকিৎসাব্যবস্থা চালু আছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি আইসিডিডিআরবি ডায়রিয়ার বড় সেবা দিচ্ছে।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত দেশে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪ লাখ ৭৩ হাজার ৩০২ জন রোগী। কোনো মৃত্যু নেই। এর মধ্যে কেউ কলেরা আক্রান্ত ছিলেন কি না, তারও উল্লেখ নেই।

বাংলাদেশ জনস্বাস্থ্য সমিতির সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন বলেন, ‘একটা সময় আমরা বিদেশে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি ও ভ্রমণের ক্ষেত্রে সমস্যা এড়াতে কলেরার বিষয়টি এড়িয়ে যেতাম বা গোপন করতাম। কিন্তু এখন তো সেই অবস্থা নেই। এখন লুকোছাপার কোনো কারণ আছে বলে মনে করি না।’

তিনি বলেন, দেশে তো কলেরা আছেই। বলতে অসুবিধা কী! যেটা ডায়রিয়া সেটাকে ডায়রিয়া বলতে হবে, যেটা কলেরা সেটা কলেরা বলতে হবে। প্রকাশ্যে কলেরা বলব না আবার বিদেশ থেকে ঠিকই কলেরার ভ্যাকসিন সাহায্য তো আনছি। এটা কেন হবে। ভ্যাকসিন আনতে তো ঠিকই কলেরার প্রাদুর্ভাবের তথ্য-উপাত্ত দিতে হয়েছে।

সরকারের রোগতত্ত্ব রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট- আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ড. তাহমিনা শিরীন বলেন, কোনো কোনো এলাকায় কলেরার কিছু আউটব্রেক হয় কিন্তু সেটাকে আমরা এক্যুইট ওয়াটারি ডায়রিয়া ডিজিজ বলি। ডায়রিয়ার চিকিৎসা প্রধানত আমাদের সঙ্গে কাজ করা আইসিডিডিআরবি (আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র) দিয়ে থাকে।

আপনারা কেন ‘কলেরা’ শব্দটি ব্যবহার করেন না বা এর ব্যাপক বিস্তারের বিষয়টি এড়িয়ে যান এমন প্রশ্নের মুখে ওই পরিচালক বলেন, ‘এটা আমি বলতে পারব না। এটা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতনদের জিজ্ঞেস করতে পারেন। তারা ভালো বলতে পারবেন।’

এদিকে বাংলাদেশ সরকারের বিএমজিএফ তহবিলের মাধ্যমে পরিচালিত দেশে কলেরা নিয়ে সার্ভেইলেন্সের সর্বশেষ একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে দেশে কলেরা রোগ (ভিব্রিও কলেরি-সংক্রামিত) খুবই কম প্রকাশ করা হয় ট্রেড ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার ভয়ে। একই প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ৬ কোটি ৬৪ লাখের বেশি মানুষ কলেরার ঝুঁকিতে রয়েছে। বছরে কলেরায় আক্রান্ত হয় আনুমানিক ১ লাখ ৯ হাজারের বেশি মানুষ এবং মৃত্যু হয় ৩ হাজার ২৭২ জন। আইসিডিডিআরবির হাসপাতালে ডায়রিয়া নিয়ে চিকিৎসা করতে আসা ২০ শতাংশ রোগী থাকেন কলেরায় আক্রান্ত।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে কলেরামুক্ত করার অঙ্গীকারাবদ্ধ ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে বর্তমানে ২৩টি দেশে কলেরার প্রাদুর্ভাব রয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে যুক্ত গ্লোবাল টাস্কফোর্স অন কলেরা কন্ট্রোল (জিএফসিসি), বাংলাদেশ সরকারের আইইডিসিআর ও বেসরকারি আন্তর্জাতিক সংস্থা আইসিডিডিআরবি যৌথভাবে এই সার্ভেইলেন্স কার্যক্রম পরিচালনা করে।

এদিকে আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদসহ একদল বিশেষজ্ঞ দেশে কলেরার বিস্তার নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন, যা সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নাল ন্যাচারে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০০-২০০৫ সালের তুলনায় ২০০৬-২০১০ সালের বছরগুলোতে কলেরা রোগী বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছিল, পরের চার বছর তা ৩ গুণ বেড়ে যায়, পরের ৫ বছর তা বেড়ে যায় সাড়ে ৩ গুণ। এ সময় দেখা গেছে কেবল পানির মাধ্যমেই নয়, গ্রাম পর্যায়ে ঘরে ও উঠানে বিভিন্ন বর্জ্য থেকেও কলেরার জীবাণু ছড়িয়েছে। এমনকি শহরের মাঝারি ও উচ্চবিত্ত পরিবারেও কলেরার ঝুঁকি রয়েছে।

এই গবেষণায় দেখা যায়, ২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত শহুরে এবং গ্রামীণ পর্যায়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ভি কলেরি পজিটিভ রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল ১৫ থেকে ৬০ বছর বয়সী রোগী। সেই সঙ্গে দেখা গেছে গত ২০ বছরে গ্রামীণ এলাকায় কলেরার প্রাদুর্ভাব ৩৯ দশমিক ১১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬২ দশমিক ৯৩ শতাংশে উঠেছে। শহরে তা ৪৯ দশমিক ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে উঠে যায় ৭১ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশে।

ওই গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর আনুমানিক এক লাখের বেশি মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশ সেই দেশগুলোর মধ্যে একটি যেখানে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ কলেরার ঝুঁকিতে রয়েছে। কলেরার প্রবণতা, কলেরা রোগের বেজলাইন এবং ক্লিনিক্যাল বৈশিষ্ট্যগুলোর পার্থক্য এবং ভিব্রিও কলেরির ক্লিনিক্যাল পর্যবেক্ষণ ধরে গবেষণা করা হয়। এ ক্ষেত্রে আইসিডিডিআরবির ঢাকা এবং চাঁদপুরের মতলব হাসপাতালের তথ্য ব্যবহার করা হয়।

এতে দেখা যায়, ২০ বছরে নারী রোগীদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ শহরে এবং ৫১ দশমিক ৬ শতাংশ গ্রামীণ এলাকার। ৫০ শতাংশের বেশি রোগীর পরিবার দরিদ্র এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত পর্যায়ের। শহুরে এলাকায় ৩০ শতাংশ পরিবার অপরিশোধিত পানীয় জল ব্যবহার করেছে এবং ৯ শতাংশ পরিবারের বাড়ির আঙিনায় বর্জ্য ছিল। উঠানে বর্জ্য ফেলার কারণে কলেরার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে ভি কলেরি ছাড়াও গ্রাম ও শহরে উভয় এলাকায় অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ রোটাভাইরাসে আক্রান্ত ছিল। এ ছাড়া শহুরে ক্যাম্পাইলোব্যাক্টরের সঙ্গে ছিল ভি. কলেরি।

দেশে কলেরার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, ‘পৃথিবীর যেসব দেশে কলেরার প্রাদুর্ভাব রয়েছে এর মধ্যে আফ্রিকা ও এশিয়ার কয়েকটি দেশে অনেক মৃত্যু ঘটছে। বাংলাদেশে সেই তুলনায় কলেরায় মৃত্যু কম। এরই মধ্যে ২০২২ সালে দেশে কলেরার খুব বড় একটা আউটব্রেক হয়ে গেছে। অনেকেই সেটা জানত না। প্রতি মিনিটে ৩ জন করে কলেরা রোগী হাসপাতালে আসে। আমরা তাৎক্ষণিক বিষয়টি সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে জানাই। তাদের কাছে সহায়তা চাই। সরকারের মাধ্যমে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কাছে টিকা চাই। সরকার তাতে সুপারিশ করে। তার মানে সরকার কলেরার বিষয়টি আমলে নিয়েছিল গুরুত্বের সঙ্গে। সে জন্যই আমরা দ্রুত বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা থেকে টিকা পেয়েছি এবং সরকারের মাধ্যমেই আমরা মাত্র ৩ মাসের মধ্যে ২৪ লাখ মানুষকে কলেরার টিকা দিয়েছি। ফলে দেশে যে কলেরা আছে, সেটা তো সরকার স্বীকার করেছে বলেই তো এত বড় কাজ সহজ হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘শুধু তাই নয়, ওয়াসা যখন পানির জীবাণু পরীক্ষা করতে শুরু করে। আমরা তখন তাদের পরামর্শ দিই ঠিক কোন জীবাণুতে এবং কোন এলাকায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। ওয়াসা তাই করেছে।’

আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘কেবল বাংলাদেশের জন্যই নয়, আফ্রিকাসহ অন্য কলেরাপ্রবণ দেশেও আমরা কলেরা প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছি দীর্ঘদিন ধরে। সেসব দেশেও নানামুখী কৌশল যাতে কার্যকর হয়, সেগুলো ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি।’

তিনি বলেন, ওরাল কলেরা ভ্যাকসিন ২ ডোজ নিলে পরবর্তী ৫-৬ বছরের জন্য কলেরামুক্ত থাকা সম্ভব। শুধু ভ্যাকসিনই নয়, কলেরা থেকে সুরক্ষায় তিনটি বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হচ্ছে সচেতনতা, প্রতিজন রোগী ব্যবস্থাপনা ও ওরাল ভ্যাকসিন নেওয়া। রোগী ব্যবস্থাপনা নিয়েই অনেক দেশ হিমশিম খাচ্ছে। ব্যবস্থাপনায় গলদ থাকলে কলেরা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না বরং আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ে।

গ্লোবাল টাস্কফোর্স অন কলেরা কন্ট্রোলের তথ্য অনুসারে, আন্তর্জাতিক ৫০টিরও বেশি সংস্থাকে একত্রিত করে ২০৩০ সালের মধ্যে কলেরার মৃত্যু ৯০ শতাংশ কমাতে প্রচেষ্টা জোরদার করতে এবং অংশীদারত্ব জোরদার করার জন্য একটি নতুন কৌশল এবং বৈশ্বিক রোডম্যাপের আওতায় কাজ করছে। যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।